“রোমান্টিক দৃশ্যে কাটপিস জুড়ে দেওয়া হত। কাকরাইলে প্রকাশ্যে ১০ হাজার টাকা করে কাটপিস বিক্রি করা হত। আমি কোনো নগ্ন ছবি করিনি। এসবের দায় আমার ঘাড়ে চলে এসেছে” – এভাবেই নিজের দুঃখের কথা জানিয়েছিলেন নায়ক মেহেদি।
মেহেদির প্রকৃত নাম নাজমুল হক শামীম। ১৯৯৩ সালে মাস্টার শামীম নামে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবিতে কাজ করেন। এটাই মেহেদির বড় পর্দায় অভিষেক। কিন্তু নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হন তোজাম্মেল হক বকুলের ‘পাগল মন’ ছবির মাধ্যমে।
মেহেদীর বর্তমান বয়স ৫৩। একটা সময় দুর্দান্ত প্রতাপে বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপিয়েছেন এই অভিনেতা। প্রথম ছবির নায়িকা ছিল অন্তরা। অন্তরা আর মেহেদি একটি জুটি হয়ে গেল। কিন্তু সেই জুটির নামটা ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। বাংলা চলচ্চিত্রের কালো একটা সময় নেমে এলো। আর সময়টা বাংলা চলচ্চিত্রের অশ্লীল যুগ হিসেবেই চলচ্চিত্রে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়। মেহেদির সাথে জুটি তখন মুনমুনের, ময়ুরীর, ঝুমকার। তবে মেহেদি-ঝুমকা জুটি বেশ পরিচিতি পায়।
আলোচিত-সমালোচিত চিত্রনায়ক মেহেদি। ‘পাগল মন’ ছবির মাধ্যমে অভিষেক হয় ঢাকাই চলচ্চিত্রে। ছবিটিও দেশের সফল চলচ্চিত্রের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়। স্বর্ণময় অভিষিক্ত সেই ছেলেটি একসময় অশ্লীল চলচ্চিত্রের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই সময় সময়কে অন্ধকার যুগ বলা হয়। আর ‘অন্ধকার যুগ শেষ হবার সাথে সাথে ময়ূরী, মুনমুন, ঝুমকা, আলেকজান্ডার বো’র মতো হারিয়ে যান মেহেদি। আসলেই কী হারিয়ে গেছেন মেহেদি? মেহেদি নিজেই জানালেন বিস্তারিত।
কিভাবে নাজমুল হক শামীম থেকে মেহেদী হয়ে গেলেন? মেহেদি চ্যানেল ঢাকা কে বলেন, ‘তোজাম্মেল হক বকুল ভাই আমার লুক পছন্দ করেছেন কিন্তু নামটা নিয়ে তার আপত্তি ছিল। তিনি বললেন আসলে শামীম নামটা তোমার সাথে যাচ্ছে না, তারপর আমার নাম দিয়ে দিলেন ‘মেহেদী। ‘ বললেন মেহেদি হলো একটা নায়কোচিত নাম। এরপর থেকে হয়ে গেলাম মেহেদী। ‘
বাংলা চলচ্চিত্রের ‘অন্ধকার সময়’-এর অভিযুক্তদের মধ্যে মেহেদি একজন। অন্তত ইন্ডাস্ট্রিতে এমনটাই উচ্চারণ হয়, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? নায়ক মেহেদি চ্যানেল ঢাকা কে বলেন, ‘আমার নাম উচ্চারিত হয়, এটা আমি জানি। আমি আলোচনায় নেই বলে শুধু আমাকেই দায়ী করবেন আপনারা? আচ্ছা বলুন আমাদের দ্বারা এসব করিয়েছে কে? তারা আজ কোথায়? তারা তো বহাল তবিয়তে আছে। আমরা কি নিজেদের ইচ্ছেতে অভিনয় করি? আমরা নিজেদের ইচ্ছাতে অভিনয় করিনি। আমাদের পরিচালক ছিলেন, তাদের নির্দেশনায় আমরা শুট করেছি। ‘
মেহেদি সেই সময়ের অভিনীত ছবিগুলোকে ‘কমার্শিয়াল’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘আমরা কমার্শিয়াল ছবিগুলোতে অভিনয় করতাম। হ্যাঁ আমরা কিছুটা উত্তেজক দৃশ্যতে অভিনয় করেছি কিন্তু ব্যাপকভাবে ‘কাটপিস’ যুক্ত করে সেই সময়টাকে অশ্লীল যুগ বানানো হয়েছে। যারা এসব করতো তাদেরকে তো কেউ অভিযুক্ত করে না। আমরা অভিনয় করে চলে আসতাম, এরপর একটা গানের দৃশ্যে কিংবা কোনো রোমান্টিক দৃশ্যে সমন্বয় রেখে ‘কাটপিস’ জুড়ে দেওয়া হতো। আর এসবের দায়ও আমাদের ঘাড়ে চলে এসেছে। ‘
কাটপিসের কুশীলব কারা? মেহেদি বলেন, ‘এটা আমাদের জানার কথা। তবে এটা জানি কাকরাইলে প্রকাশ্যে ১০ হাজার টাকা করে কাটপিস বিক্রি করা হতো। ছবির নির্মাতা, প্রযোজকেরা সেসব কিনে স্কেচ টেপ দিয়ে সেলুলয়েডে যুক্ত করতেন। কাকরাইলে এই ঘটনা তো ওপেন সিক্রেট বিষয় ছিল। তবে আমি যখন বাংলা ফিল্মে একদম এসব ঢুকে পড়ছে,। অনেক অভিনেতা ক্যামেরার সামনে সব করছে তখন আমি ফিল্ম ছেড়ে দেই। আমি ফিল্ম ছেড়ে দেওয়ার পর অনেক নামের নায়ক-নায়িকা এসেছেন যারা কাপড়ের ধার ধারতেন না।’
মেহেদি জানান তিনি ইচ্ছে করেই আলোচনায় আসেন না। অভিনয় থেকে দূরে নেই। কিছুদিন আগেই তার অভিনীত ‘বুলেট বাবু’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। রংবাজ ছবির পরিচালক মান্নান গাজীর ‘প্রেমে অনেক জ্বালা’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার অর্ধেক কাজ সমাপ্ত। এছাড়াও ‘বস্তির সম্রাট’ নামের একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সার্কাসেও কাজ করেন তিনি। তবে এসবকে পাশ কাটিয়ে শিগগির পরিচালক হয়ে মেহেদি ঢাকাই চলচ্চিত্রে ফিরতে চান। এমনটাই চ্যানেল ঢাকা কে জানালেন এই অভিনেতা।
‘বালিকা হলো বঁধূ’, ‘শুধু তোমারই’, ‘শত জনমের প্রেম’, ‘পরাণ কোকিলা’, ‘গরিবের অহংকার’, ‘মর্যাদার লড়াই’, ‘নষ্ট ছাত্র’, ‘গরিবের বিচার নাই’ এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মেহেদি। নায়ক হিসেবে ৪৫০ টি ছবি করা এই অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। মেহেদি বলেন, ‘এখন অনেক সম্ভাবনাময় অভিনেতা অভিনেত্রী আসছেন। নতুনদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ভালো চলচ্চিত্র এখন হচ্ছে। চাইলে আরো ভালো চলচ্চিত্র করা সম্ভব। আগে যেমন রাজ্জাক-কবরি, ফারুক-ববিতা, শাবানা-আলমগীর জুটির হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ছবি নির্মাণ করা হতো এখনো সে ধরনের ছবি নির্মাণ করা প্রয়োজন। এখন সিনেমা হলে মেয়ে দর্শক নেই। নারীদের হলে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। এখন আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি নতুনভাবে। ‘
মেহেদি বিএ পাস করেন ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। বনেদি পরিবারের ছেলে মেহেদিদের পুরান ঢাকায় ব্যবসা রয়েছে। রয়েছে মতিঝিলে পেট্রোল পাম্প। এসবের বাইরেও এই অভিনয় নিয়েই আগ্রহ তাঁর। বিয়ে করেছেন পুরান ঢাকার মেয়ে ফারজানাকে। স্ত্রী হাউজওয়াইফ। মেহেদি-ফারজানার ঘরে রয়েছে দুই সন্তান। ছেলে মাজহারুল হক মাহির বয়স ৮, মেয়ে মেহজাবিন হক ইশরাতের বয়স ৬। সংসার জীবনে মেহেদি সুখি বলেই জানালেন। চাইলেন সবার নিকট শুভ কামনা।